আমি হলে ছিলাম অনেকগুলো বছর ।
আমাদের ইফতার হতো একটু অন্য লেভেলের । আশেরপাশের দুই চার রুম মিলিয়ে এক রুমে জড়ো হয়ে ইফতার করতাম । ভিন্ন ধর্মের অনেক বন্ধুরাও আমাদের সাথে থাকতো । এটা নিয়ে কোনদিন কোন সমস্যা হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না ।
একবার ক্যাম্পাসে হলো মারামারি ।
স্বাভাবিক ভাবেই হলে ফেরাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেলো । ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে । এক নম্বর গেট থেকে সিএনজিও চলে না । এদিকে ইফতারের সময়ও হয়ে গেছে । আমার বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে এলো রামকৃষ্ণ মিশনে । সেখানেই ইফতার করেছিলাম আমি ।
পড়াশুনা শেষ করেছি বেশ কয়েবছর হলো । ভাবতে অবাক লাগে এখন প্রজ্ঞাপন জারি করে ইফতার করতে নিষেধ করা হয় । কেন করা হয়েছে আমার জানা নেই । এখন ঘোষণা দিয়ে ছেলে মেয়ে গুলো গণ ইফতার কর্মসূচি পালন করে । আমাদের সময় এমন ছিল না । তখন প্রতিটা রমজানই ছিল কোন না কোন গণ ইফতার ।
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি , আচমকা একজন ডাক দিলো , দোস্ত চলে আয় আজকে আমাদের সমিতির সাথে ইফতার করবি । কাল হয়তো আরেকজন নিয়ে যাচ্ছে অন্য সার্কেলের কোন ইফতারে ।
ষোলশহর স্টেশনে বসে অসংখ্য দিন ইফতার করেছি । সাথে ক্যাম্পাসের কেউ না কেউ জুটে গেছেই । কেউ হয়তো চারুকলায় পড়াশুনা করে । কেউ হয়তো ভিন্ন ধর্মের । কেউ হয়তো ভিন্ন মতবাদের । কিন্তু ইফতার করেছি একসাথে । কোন সমস্যা হয় নাই । এমনও হয়েছে চার পাঁচজন একসাথে বসে ইফতার করছি , কিন্তু কেউ কাউকে চিনিই না । শুধু একটাই ট্যাগ ,আমরা সবাই এক ক্যাম্পাসের ছাত্র ।
ইফতারের কালচারটা আমাদের দেশে এমনই অসাম্প্রদায়িক । ইফাতারের কালচারটা আমাদের দেশে এমনই সুন্দর ।
ইন দ্যা মিন টাইম আপনাদের কয়েকটা উদাহরণ দিই ।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে নিজস্ব ক্যাটারিং সার্ভিস আছে ।
রোজার মাস উপলক্ষে তারাই মুসলিম ছাত্রদের জন্য ইফতার সরবারাহ করে । এটা যে শুধু এক মাসের ঘটনা তা কিন্তু নয় । সারা বছরই মুসলিম ছাত্রদের জন্য হালাল হারাম মেনে তারা খাবার সরবারাহ করে । এতে করে হার্ভার্ড সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়নি । র্যাংকিং এর দিকেও তারা পিছিয়ে পড়েনি ,এমনকি তাদের মান কমে যায়নি ।
রমজান মাসে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাদের মুসলিম ছাত্রদের জন্য ফ্রি ইফতার সরবারাহ করে । সেদিন দেখলাম অক্সফোর্ডের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজ থেকে রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে পোস্ট দেয়া হয়েছে । এতে করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা আছে ,এমন ভাবার কারণ নাই । অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং এর দিক দিয়েও পিছিয়ে পড়ে নাই ।
আমাদের দেশের কথিত যেসব ক্যাম্পাস গণ ইফতার বন্ধ করতে চেয়েছে , তারা কেন এমন করতে চেয়েছেন ,তা বোধগম্য নয় । কোয়ালিটির দিক দিয়ে তারা হার্ভার্ড আর অক্সফোর্ডের ধারে কাছে আছে কিনা সন্দেহ । যদি এমন হয়ে থাকে যে তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন কারতে কাজটি করেছেন ,তাহলে আমি বলবো ,তারা কোন দিক দিয়েই বিশ্বের বড় বড় ক্যাম্পাস থেকে বেশি অসাম্প্রদায়িক নয় । বরং এসব ব্যাপারগুলোকে বলা যায় ট্রিগারিং করা । কাউকে বা কোন সম্প্রদায়কে পরিকল্পিতভাবে খেপিয়ে তোলা ।
লেখাটা শেষ করি একটা সুন্দর ঘটনা দিয়ে । এটা আমার জব লাইফের গল্প ।
ওভারটাইমের জন্য ইফতার করতে হচ্ছে অফিসে । আমার পাশে এক কলিগ বসলেন । উনি ভিন্ন ধর্মের অনুসারী । হাসিখুশি মানুষ । ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ার পরেও উনি দেখলাম ইতস্তত করছেন ।
জিজ্ঞেস করলাম , ভাই ইফতার করবেন না ?
উনি বললেন , ভাই আসলে আমি ভুলে গিয়েছি আগে কোনটা দিয়ে শুরু করবো । পানি নাকি খেজুর । আপনাদের ধর্মে মনে হয় আগে খেজুর দিয়ে শুরু করার বিধান আছে । আসলে বছরে একবার করে রমজান আসে তো ,তাই আমি ভুলে গিয়েছি ।
একজন ভিন্ন ধর্মের মানুষ যদি ইফতারের কালচার নিয়ে এতোটা সচেতন হতে পারে ,তাহলে আমি জানতে চাই , যারা প্রজ্ঞাপণ জারি করে গণ ইফতার বন্ধ করতে চান ,তারা আসলে কোন কালচারের মানুষ ? এবং তাদের লক্ষ্যটা আসলে কি ?
© Arafat Abdullah